সময় ব্যবস্থাপনা – “টাইম নাই… টাইম নাই…
0 Comments
13 min read
Rate this post
সময় ব্যবস্থাপনা - "টাইম নাই... টাইম নাই...
(সময় ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু কথা)
বদরুল মিল্লাত
৮০’র দশকে বিটিভিতে সম্ভবত একটা ধারাবাহিক নাটক চলত, যেটার ‘মামা টাইপ’ একটা মজার চরিত্র ছিল, যাকে কিছু করতে বললেই তিনি গম্ভীর হয়ে বলতেন ‘টাইম নাই, টাইম নাই’। ওই সময় এই উক্তিটা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। অনেকবছর আগের বলেই নাটক, লেখক, চরিত্রটির নাম বা সালটি আমার মনে নেই, শুধু এই সংলাপটা মনে আছে, এমনকি এখনো আমরা বন্ধুবান্ধবরা মোবাইলে কথা বলার বা সামনে দেখা হলে এটা বলি।
তবে প্রায় ত্রিশ বছর পরও এই ‘সংলাপ’ আজ আমরা চারিদিকে প্রায়ই শুনি। “ভাই, আমাদের ওদিকে আসেন না কেন?” “বাবা-মাকে দেখতে গ্রামে কবে গিয়েছ?” “গল্পের বই পড়িস না কেন?” ইত্যাদি ধরণের প্রশ্নের উত্তর একটা – “ভাই টাইম পাই না”। অর্থাৎ চারিদিকে একই হাহাকার “টাইম নাই… টাইম নাই!”
তাহলে ‘টাইম’ জিনিসটা গেল কই? আগে চব্বিশ ঘণ্টা বা একহাজার চারশো চল্লিশ মিনিট কি এখন কমে গেছে? যদি না কমে থাকে, তাহলে “টাইম নাই” কেন? এর একমাত্র উত্তর, আমরা সময়কে ম্যানেজ করতে পারছি না।
তাহলে কি বলা যায়, এই প্রযুক্তি এসেই আমাদের টাইম খেয়ে ফেলছে? আমরা আর কিছুই করার টাইম পাচ্ছি না? প্রযুক্তি আগে ছিল এখনো আছে, ভবিষ্যতে নতুন আরও অনেক কিছু আসবে। প্রযুক্তির এখানে কোনো দোষ নেই, দোষ এর ব্যবহারে। এবং একারণেই এখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে- টাইম ম্যানেজমেন্ট।
টাইম ম্যানেজমেন্ট বা সময় ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইয়া মোটকা মোটকা বই, ইন্টারনেটে হাজার হাজার ফিচার, মটিভেশনাল লেকচারারদের লম্বা লম্বা বক্তৃতার ভিডিও বা লাইভ, আজকাল খুব সহজেই পাওয়া যায়। তারপরেও টাইম ম্যানেজমেন্টে এত সমস্যা কেন? কারণ সেসব পড়ার বা শোনার “টাইম” আমাদের নেই!
সময় ব্যবস্থাপনাকে এককথায় বলতে চাইলে, আপনি আপনার কাজগুলোকে এমনভাবে পরিকল্পনা করবেন ও সাজাবেন যেন কোন কাজটা কখন করতে হবে, কতটা সময় লাগবে সেটা আগে থেকেই জানেন। ভালো সময় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কম সময়ে বেশি পরিমাণ কাজ করা সম্ভব। আর ‘বেশি কাজের’ মধ্যে যদি আপনার পরিকল্পিত কাজগুলো হয়েই যায়, তার মানে আপনি কিছু ‘ফ্রি সময়’ পাচ্ছেন! যে সময়টা আপনি আপনার ইচ্ছেমতো অন্য কাজে লাগাতে পারবেন, পরিবার বা বন্ধুদের দিতে পারবেন। এতে আপনার ওপর থেকে চাপ বা স্ট্রেস কমে যাবে। ভালো সময় ব্যবস্থাপনা – কার্যকরীতা, দক্ষতা ও মানের উন্নতি করে এবং আপনার ওপরে চাপ কমানোর মাধ্যমে জীবনে সফলতা আনতে সাহায্য করে।
আসলে এটা নিয়ে আমার লেখার কিছুই নেই। আমি যা কিছুই লিখব, আপনারা পড়ে (যদি পড়ার টাইম পান!) বলবেন, “ধ্যাৎ, এগুলো আর নতুন কী, আমি তো এ সবই জানি।” আসলেই আপনি সব জানেন। কিন্তু সমস্যা হলো “মানেন না”। কিংবা, যখন প্রয়োজন, তখন সেটা মনে করার চেষ্টা করেন না। তবে এটা ঠিক, প্রত্যেকেরই জন্মগতভাবেই সময় ব্যবস্থাপনার একটা নিজস্ব স্টাইল থাকে। যেটা একজন থেকে অন্যেরটা ভিন্ন। তাই কোনো পুথিগত শিক্ষা বা টাইম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা না করেই আপনি সময় ব্যবস্থাপনা ঠিকই করে যাচ্ছেন। এবং অবাক হয়ে দেখবেন, এর মধ্যেও কেউ কেউ অন্যের চেয়ে ভালো ব্যবস্থাপনা করছেন! তবে কিছু বিষয় জানা থাকলে সময় ব্যবস্থাপনাটা নিঃসন্দেহে আগের চেয়ে ভালোভাবে করা যাবে।
আজকের এই প্রবন্ধটা লেখার জন্য আমি একাধিক বই ও অনেকগুলো ইন্টারনেট ফিচারের সাহায্য নিয়েছি। কিন্তু এতে এমন অনেক কথাও আপনি পাবেন, যেটা হয়তো কোথাও কখনোই লেখা হয়নি। লেখা না হলেও, সেটাও আপনি জানেন! ভালো ব্যবস্থাপনার জন্য কিছু টিপস অনুসরণ করা যেতে পারে। আমি সংক্ষেপে কয়েকটি টিপস নিয়ে আলোচনা করব। তবে বইয়ের বাইরে, আমি আপনাদেরকে নতুন (আপনাদের কাছে নতুন নয়) একটা বিষয়ের সাথে আগে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।
সময় চব্বিশ ঘণ্টা। এই সময়ের তিনটা বড় ভাগ যদি করা হয়, তাহলে সম্ভবত (১) ঘুম- ছয়ঘণ্টা (একজন পূর্নবয়ষ্ক মানু্যের ছয় ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট তবে শিশু ও বয়ষ্কদের জন্য এটা আট থেকে দশ ঘণ্টাও হতে পারে), (২) আনুসাঙ্গিক প্রয়োজনীয় কাজসমূহ(বাথরুম, গোসল, নামাজ, খাবার, বৈকালিক হাঁটা ইত্যাদি) – তিন ঘণ্টা, (৩) অবশিষ্ট রইল পনেরো ঘণ্টা, যেটা আপনার কাজের জন্য পাচ্ছেন।
কাজ বলতে এক এক পেশার মানুষের জন্য এক এক রকম হতে পারে। সেজন্যই টাইম ম্যানেজমেন্টও বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন চাকুরিজীবী, ছাত্র, গৃহিনী (এগুলোরও লেভেল থাকবে) ইত্যাদি। আপনি যেই পেশারই হোন না কেন, এই পনেরো ঘণ্টার পরিকল্পনা আপনাকেই করতে হবে, যেটার ব্যাপারে কিছু টিপস আমি পরে দেব। তবে এখন বলতে যাচ্ছি আপনাদের অধিকাংশের সবচেয়ে আপত্তিকর ও বিব্রতকর বিষয়টি নিয়ে!
আপনি দিনে কতটা সময়“অপচয়” করেন?
আমার এই প্রশ্ন শুনে অনেকেই নাঙ্গা তলোয়ার (!) নিয়ে আমার দিকে ছুটে আসবেন।
“আমি আবার সময় অপচয় করি কে বলল?”
“না, মানে…, ওই যে সারাক্ষন দেখি মোবাইলে…”
“তো? মোবাইলে চাপাচাপি করি মানেই কি সময় অপচয় করছি? জানেন, আমার থিসিসের অনেক ম্যাটেরিয়েল আমি এই মোবাইল, মানে ইন্টারনেট থেকে নেই।”
“তা তো অবশ্যই, কিন্তু… ইয়ে মানে, তলোয়ারটা দয়া করে খাপের ভেতরে রেখে কথা বলুন, তাহলে আমি শান্তি পাই। মানে বলছিলাম, ফ্রেন্ডদের সাথে একদমই চ্যাট করেন না?
“অবশ্যই করি। কেন করব না। আর আমি তো জরুরি বিষয়ে দশ/পনেরো মিনিট বন্ধুর সাথে চ্যাট করতেই পারি, তাই না। কিন্তু আপনার তাতে কী সমস্যা?”
“না আমার কোনো সমস্যা নেই, তবে সেই চ্যাট করতে করতে যে কখনো দুইঘণ্টা, বা ফজরের আজান শোনা যায়…”
এই সংলাপের কোনো শেষ নেই। মূল কথা হলো আপনি একজনকে তার ভুলটা যতই বোঝাতে চাইবেন, সে ততই শক্ত প্রতিরক্ষা নিয়ে নিজের কাজটাকে জায়েজ করতে সচেষ্ট হবে। সে জন্য আমার একটা পদ্ধতি আছে, সেটা হলো “আসক ইয়োরসেলফ” বা নিজেকে জিজ্ঞেস করো পদ্ধতি।
আসক ইয়োরসেলফ পদ্ধতিতে আপনি একদিন রাতে নিজের রুমের ভেতরে একা বসে একেবারে শান্ত হয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে, নিজের বুকের বামপাশে হাত রেখে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আজ যা কিছু করেছেন, তার মধ্যে ঠিক কোন কোন কাজটা না করলেও চলত? মোবাইলে বা ইন্টারনেটে যতবার ঢুকেছেন, তার মধ্যে কত মিনিট সত্যিকারের ‘কাজের’ ছিল? আপনি বিস্মিত হয়ে লক্ষ করবেন, আপনি ঠিক উত্তরটি পেয়ে গেছেন। আপনার মধ্যে একটা অনুশোচনা আসবে, একটা প্রতিজ্ঞা চলে আসবে – ‘ওই সময়গুলো’ আর ওভাবে অপচয় করবেন না।
যদি কেউ তার চব্বিশ ঘণ্টা বা আরও সরাসরি বললে – কাজের জন্য নির্ধারিত পনেরো ঘণ্টার প্রকৃত অর্থে অপচয় না করে নির্ধারিত একটি পরিকল্পনা অনুযায়ী তার কাজগুলো করতে পারে, তাহলে আর টাইম ম্যানেজমেন্টের মোটকা মোটকা বই, হাজারো ফিচার, বিদগ্ধ লেকচারারদের বোরিং লেকচার এমনকি আমার এই ছাইপাঁশ লেখাটিও পড়ার কোনো প্রয়োজন হবে না।
আপনি যদি এতটুকু পারেন, আমার মতে আপনার টাইম ম্যানেজমেন্টের ৮০% অর্জন করে ফেলেছেন। বাকি ২০% অর্জনের জন্য হাজারো বই, ফিচার পড়ে বা গুণীজনদের লেখা থেকে নিয়ে লেখা আমার নিচের টিপসগুলো কাজে লাগাবেন।
তবে একটা কথা সদাসর্বদা মনে রাখবেন, জীবনে উন্নতি করতে চাইলে টাইম ম্যানেজমেন্টের বিকল্প কিছু নেই। এটা দশজনের উপদেশে কোনো কাজে লাগবে না, আপনার টাইম আপনাকেই ম্যানেজ করতে হবে।
চলুন তাহলে দেখা যাক, কিছু দক্ষতা, পদ্ধতি, নিয়ম বা প্রণালি সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করি, যা আপনাকে সময়ের সঠিক ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করবে;
অর্গ্যানাইজড বা সংগঠিত থাকা: আপনার পড়ার/অফিসের টেবিল, বাসার কাপড়ের ক্লোজেট, আপনার পার্স বা মানিব্যাগটি একেবারে ছিমছাম গোছানো রাখুন। এতে যে কোনো জিনিস যেখানে আছে সেখানে হাত দিলেই পাবেন। কোনো কিছু খোঁজার জন্য একটা মুহূর্তও নষ্ট হবে না। অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র (টেবিলের বই, কাগজ বা অব্যবহ্যৃত কাপড়চোপড় নিয়মিতভাবে ফেলে দেয়ার অভ্যাস করুন। “মায়া” লাগিয়ে কোনো জিনিস রেখে দেয়ার কোনো অর্থ হয় না।
আগে থেকেই পরিকল্পনা করা: প্রতিটি কাজের আগে একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। সেটা মনে মনে হোক বা লিখিত। তবে নিজের একটা “টাইম ম্যানেজমেন্ট নোটবুক” ধরণের একটা ছোট্ট নোটবুক করে সেটাতে আপনার দৈনিক কাজগুলো লিখে ফেলতে পারেন। এটা শুধু দৈনিক নয়, আগামী দিনের (সপ্তাহ, মাস, বছর, জীবন) পরিকল্পনাও থাকতে পারে। এজন্য ক্যালেন্ডার খুব উপকারি একটি টুল। আজকাল বিশাল সাইজের ক্যালেন্ডার বয়ে বেড়াতে হয় না। আপনার মোবাইলেই চমৎকার একটি ক্যালেন্ডার আছে, যেখানে এমনকি সংক্ষেপে কাজগুলোও লিখে রাখা যায়, আর আপনি ভুলে যাতে না যান, সেজন্য এলার্ম দেয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। পরিকল্পনা আগে থেকে করা থাকলে, নতুন কিছু মাঝখানে এসে পড়লে আপনি তখন বিবেচনা করতে পারেন, কোনটা বেশি জরুরি বা গুরুত্বপূর্ন। এবং সে অনুযায়ী আপনি চাইলে পরিকল্পনায় পরিবর্তনও করতে পারেন।
প্রায়োরাটাইজ বা অগ্রাধিকার নির্ধারণ: এই পরিকল্পনার যে তালিকা রয়েছে, সেটার একটা ক্রম থাকতে হবে। দুটি বিষয় মাথায় রেখে এটা নির্ধারণ করতে হবে, কাজের গুরুত্বের ভিত্তিতে এবং সময়ের ভিত্তিতে। কাজের গুরুত্বের ভিত্তিতে করা তালিকাটিকে ‘এমআইটি’ বা ‘মোস্ট ইম্পোর্টেন্ট টাস্ক’ বলা হয়ে থাকে। এগুলো এমন কাজ, যদিও আপনার তালিকার সবগুলোই করতে হবে, কিন্তু এই কয়টা না করলেই নয়। আর সময়ের ভিত্তিতে অর্থ হলো, বিকালের একটা কাজ আপনি চাইলেও সকালে করতে পারবেন না, তাই সেটা প্রায়োরিটি তালিকায় থাকবে ঠিকই, কিন্তু মাঝে কম গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ থাকতে পারে। এমআইটিগুলোকে অন্য রঙে লিখতে পারেন।
দৈনন্দিন লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য প্রতিদিনের একটি রুটিন করা খুব ভালো অভ্যাস এবং সেই রুটিন অনুযায়ী আজকের কাজ কী কী হবে, সেটার একটা তালিকা করে ফেলা যায়। প্রতিটি কাজের জন্য একটা সময় বরাদ্ধ এবং সময়সীমা নির্ধারণ করে নিলে আরও ভালো। যেমন, “সকাল দশটায় ভার্সিটির জন্য বাসা থেকে বের হতে হবে, ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ক্লাস, তারপর ৪টায় বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে গিয়ে একটা মোবাইলের কাভার কিনতে হবে, ৫টার সময় বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়ে ৬টার মধ্যে পৌঁছে যাব।”
আপনার উদ্দেশ্য হবে, এই তালিকার সবগুলো কাজ যেভাবে পরিকল্পনা করেছেন, ঠিক সেভাবেই করা। অনেক সময়ই যেভাবে ভেবেছেন, সেভাবে কাজটি নাও হতে পারে, তাহলে বিকল্প কী করা যেতে পারে সেটাও পরিকল্পনায় থাকতে হবে। রাতে ঘুমানোর আগে একবার আপনার তালিকাটায় চোখ বুলান। দেখুন সবকিছু আপনার প্ল্যানমাফিক হয়েছে কি না। না হলে কোথায় সমস্যা ছিল। ভবিষ্যতে এই সমস্যা এলে কীভাবে সেটা দূর করবেন।
লক্ষ্য নির্ধারণ বা গোল সেটিং: এটা দুই ধরণের হতে পারে। এক, ভবিষ্যতের (পরবর্তি সপ্তাহ, মাস, বছর এমনকি জীবনের) লক্ষ্য কী, দুই, আজ আপনার কাজ কী কী। জীবনের লক্ষ্য স্থির করা হলে সেটার পেছনে লেগে থাকলে সফলতা আসবেই, কিন্তু কোনো লক্ষ্যই যদি আপনার না থাকে তাহলে আপনি কোথাও পৌঁছতে পারবেন না। আমার “আমেরিকা আমেরিকা” বইটিতে ‘আমেরিকান ড্রিম’ নামে একটা অধ্যায় লিখেছি। প্রতিটি আমেরিকানের একটি ড্রিম বা স্বপ্ন থাকে, যেটা অবাস্তব কিছু না হলেও অর্জন করতে প্রচুর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় থাকতে হয়। আমাদের দেশে এমন নামে হয়তো ডাকা হয় না, তবে আমাদেরও কিন্তু সবার একটা ‘বাংলাদেশি ড্রিম’ আছে। যেমন আপনি শিক্ষক বা ডাক্তার হতে চান, জার্মানিতে লেখাপড়া করতে যেতে চান বা আপনার একটা গাড়ি হবে, ইত্যাদি। যদি কোনো স্বপ্নই না থাকে, তাহলে আপনি কীসের পেছনে ছুটবেন? জীবনে কী অর্জন করতে চাইবেন?
ডেলিগেশন বা আউটসোর্সিং: আপনার অনেক কাজই আছে, যা আপনি একটু অনুরোধ করে অন্যকে দিয়ে করিয়ে আপনার সময় বাঁচাতে পারেন। যেমন ভার্সিটিতে যাবেন, দেরি হয়ে যাচ্ছে, আপনি বাথরুমে ঢোকার আগে ছোটবোনটিকে অনুরোধ করলেন শার্টটি ইস্ত্রি করে দিতে। আপনার টাইপিং স্পিড ভালো না, ভুলও প্রচুর হয়, কোনো বন্ধুকে অনুরোধ করে বা কিছু টাকা খরচ করে কম্পিউটারের দোকান থেকে আপনার রিসার্চ পেপারটা টাইপ করিয়ে নিতে পারেন।
মাল্টিটাস্কিং বা একই সাথে কয়েকটি কাজ করা: মনে হয় যেন একইসাথে কয়েকটি কাজ করলে সময় অনেক বাঁচবে। কিন্তু আমাদের হাত দুটি, আর ব্রেন একটি। ব্রেন সৃষ্টিকর্তা এমনভাবে তৈরি করেছেন যে, ‘সে’ একইসাথে দুইটি জায়গায় ফোকাস করতে পারে না। তাহলে একই সাথে দুটি কাজ করার প্রশ্ন অবান্তর। তবে হ্যাঁ, এমন কিছু কাজ আছে যেগুলো একত্রে করতে চাইলে শরীরের ভিন্ন অঙ্গ ভিন্ন কাজ করলেও ব্রেন তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেমন সাইকেল চালাতে চালাতে মোবাইলে কথা বলা বা রান্না করতে করতে টিভির খবর দেখা। তবে সময় ব্যবস্থাপনায় মাল্টিটাস্কিং বা একাধিক কাজ একত্রে করাকে সমর্থণ করে না, কারণ এতে সময় আরও বেশি লাগে। উপরোক্ত দুটি কাজ যদিও একত্রে করা যায়, কিন্তু মোবাইলে কথা বলতে গিয়ে সাইকেল দুর্ঘটনা বা খবর দেখতে গিয়ে রান্না পুড়ে যেতে পারে। আর আপনার পেশাগত কাজ, যেমন পড়া বা কিছু লিখতে গিয়ে ফোনে কথা বললে কাজটি ভালো হবে না, সময়ও তেমন বাঁচবে না। আরেকটা টার্ম আছে যাকে ‘হাফ ওয়ার্ক’ বলে। ধরুন আপনি একটা রিপোর্ট বা গল্প লিখছেন, এমন সময় বন্ধুর ফোন এলো, আপনি ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন, বা বই পড়া শুরু করলেন। পরে ফিরে যখন আবার কাজে বসবেন, আপনার আগের সেই ফ্লো থাকবে না, কনসেন্ট্রেশন ফিরিয়ে আনতে অনেক সময় লাগবে। অনেকগুলো কাজ করতে গেলে দেখা যাবে সবগুলোই কিছু না কিছু হয়েছে, কিন্তু আসলে একটাও সম্পূর্ন হয়নি, মানে আপনার কোনো কাজই হয়নি। তাই গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ (আসলে অধিকাংশ কাজই গুরুত্বপূর্ণ) করার সময় ফোনটা অফ করে রাখতে পারেন।
অপ্রয়োজনীয় কাজ পরিহার করা: আপনি যখন আজ রাতে আগামীকালের কাজের তালিকা বানাচ্ছেন, দেখবেন এমন অনেক কিছু চলে এসেছে, যেটা না করলেও চলে। যখন আপনি চাপে আছে, ধরুন পরীক্ষা চলছে, তখন যদি অমুক বন্ধুর সাথে সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে যাওয়া আপনার তালিকায় থাকে নিঃসন্দেহে সেটা বাদ দেয়া যায় বা উচিৎ।
কাজের মধ্যে বাধা: আপনি অফিসে বসে খুব গুরুত্বপূর্ন একটা কাজ করছেন, এমন সময় আপনার এক বন্ধু চলে এলো ‘আড্ডা’ দিতে। কিংবা বাসায় বসে পড়ছেন, মা বললেন দোকান থেকে তমুক জিনিসটা এনে দিতে। এধরনের বিষয়গুলো বাদ দেয়া সম্ভব না, তবে আপনি স্মার্ট হলে কমাতে পারবেন। এবং সে জন্যই “না” বলাটা আপনাকে শিখতে হবে। আপনি যদি আপনার বন্ধুটিকে সুন্দর ভাষায় বুঝিয়ে বলেন যে, আপনি খুবই ঝামেলার মধ্যে আছেন সন্ধ্যায় বাসায় যাওয়ার পথে তার হলে গিয়ে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আসবেন, আশা করি সেই বন্ধুটি মাইন্ড করবে না। করলেও কিছু যায় আসে না। আপনাকে আপনার কাজের গুরুত্ব বুঝতে এবং সে অনুযায়ী সেটা শেষ করতে হবে। এমনকি আপনার মা যেন কাজের মধ্যে আপনাকে কোথাও পাঠাতে না পারেন, আপনি পড়তে বসার আগেই হয়তো তাকে বললেন, যে আপনি জরুরি একটা কাজ করতে বসছেন, কিছু লাগলে এখনই বলতে, আপনার মাও আশা করি কিছু মনে করবেন না। আসলে “না” বলাটা একধরণের আর্ট, যেটা আমরা অনেকেই পারি না।
এ ব্যাপারে খুব মজার একটা কৌতুক আছে,
“প্রশ্ন: ডিপ্লোম্যাট বা কূটনীতিক কাহাকে বলে?
উত্তর: কূটনীতিক হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি আপনাকে এমনভাবে “জাহান্নামে যাও” বলবেন যে, আপনি সেই দারুণ, মনোরম (!) জায়গাটায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়বেন!”
তো আপনি “ডিপ্লোম্যাট” হওয়ার চেষ্টা করুন।
অপেক্ষায় থাকার সময়ের ব্যবহার: অন্যান্য দেশে না হলেও আমাদের দেশের একটা উল্লেখযোগ্য সময় পথে জ্যামে পড়ে চলে যায়। তাছাড়া ডাক্তারের জন্য, টিকিটের লাইনে, ব্যাঙ্কের লাইনে অপেক্ষা…এসবের শেষ নেই। কিন্তু সেই সময়টা তো আপনার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেরই সময়। যদিও আপনি ভার্সিটি যাওয়া আসার পথে জ্যামের সময়টা মাথায় রেখেই কাজের তালিকা বানিয়েছেন, কিন্তু সেই সময়টা আপনি বিভিন্ন কাজ করে এগিয়ে থাকতে পারেন, বা অন্তত বিরক্তি কমাতে মনোরঞ্জন করতে পারেন। আপনার মোবাইলের “অতি জরুরি” যে কাজগুলো আপনার পড়ার সময় খেয়ে ফেলে, যেমন গান শোনা বা বন্ধুর সাথে চ্যাট, সেগুলো করতে পারেন, গল্প লিখতে পারেন বা বই পড়তে পারেন। কারণ ছোট্ট একটা ডিভাইস, এই মোবাইলেই সব করা যায়। এমনকি সিরিয়াস পাবলিক হলে বা আপনি চাপে থাকলে ক্লাসের বই পড়া (আগেই পিডিএফ বানিয়ে মোবাইলে লোড করে নিয়ে) বা কোনো রিপোর্ট এমনকি থিসিস লেখার কাজটিও চালিয়ে যেতে পারেন।
একই ধরণের কাজের গ্রুপিং: শুধু একই ধরণের নয় একই পথে যাওয়ার সময় আগে থেকে পরিকল্পনা থাকলে সময় বাঁচানো যেতে পারে। যেমন অফিসে যাওয়ার একটু আগে আগে বেরিয়ে গেলেন, ফার্মগেটে নেমে গ্রামীন ফোনের কাস্টোমার কেয়ার থকে আপনার সিম কার্ডের সমস্যাটা দূর করে পরের বাসে চলে গেলেন।
দীর্ঘসূত্রিতা বা সময়ক্ষেপণ: এই শব্দটির ইংরেজিটা খুব সুন্দর একটা শব্দ – প্রোকাস্টিনেশন। সোজা বাংলায়, কোনো কাজ, সেই সময়ে না করে ‘পরে করব’ বলে ফেলে রাখাা বা কালক্ষেপন করা। আপনাকে একটা কাজ দিয়ে বলা হলো, “কখন দেবে?” আপনি বললেন, “কাল দিয়ে দেব”। সমস্যা এখানেই, কাল বা আগামীকাল যখন আসলো, সেটা তো“আজ” হয়ে গেছে, কাল চলে গেছে একদিন সামনে! তাই “কাল” কোনোদিনও আসবে না। তাই আর্মিতে সেটার উত্তর হবে, “একুশ তারিখ, শনিবার, সকাল দশটায়, আপনার টেবিলে থাকবে।” যারা অলস, তারাই দীর্ঘসূত্রিতার আশ্রয় নিয়ে থাকে।
জীবনের আনন্দ: এতক্ষণ কাঠখোট্টা সব বিষয় দেখে অনেকেই ভাবছেন, তাহলে কি আমাদের জীবনে আনন্দের কিছুই থাকবে না? বন্ধুদের সাথে আড্ডা, টিভি/সিনেমা দেখা, আত্মীয়দের বাড়িতে যাওয়া, সামাজিকতা রক্ষা, এসব? এসব তো আমি মানা করিনি! আপনার দৈনিক কাজের মধ্যে তালিকা করার সময় এসবও থাকবে। এমনকি বার্ষিক পরিকল্পনায় কক্সবাজার বা কাপ্তাই বেড়াতে যাওয়ার কথাও উল্লেখ থাকবে। এমনকি দৈনিক কিছুটা সময় টিভি বা মুভি দেখার সূচিও থাকবে। তবে সাবধান। কখনোই কোনো টিভি সিরিয়ালে ‘আসক্ত’ হবেন না।
তাছাড়া ছুটির দিনগুলোতে আনন্দ যেমন করবেন, যে কোনো একটা বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের চেষ্টাও করুন। আজকাল আর “আমি অমুক সাবজেক্টে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেনিতে পাশ করেছি”র কোনো দাম নেই, যখন আপনি সামান্য এমএস ওয়ার্ড ও এক্সেলই জানেন না! আপনারা হয়তো পড়েছেন বা শুনে থাকবেন যে, বিশ্বের শীর্ষ তিনটি কোম্পানি গুগল, আইবিএম ও অ্যাপেল সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, তাদের কোনো কলেজ ডিগ্রির প্রয়োজন নেই, তাদের দরকার দক্ষতা।
হাজার হাজার টিপস থেকে এগুলোই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, কারণ এর শেষ নেই। টাইম ম্যানেজমেন্টের জন্য আপনি ইন্টারনেট, বই বা গুরুজনদের কাছ থেকে অনেক অনেক পদ্ধতি, আইডিয়া, বুদ্ধিপরামর্শ পাবেন। তবে সেটা যদি আপনি কাজেই না লাগান তাহলে সেসব পড়ে, জেনে বা শুনে কী লাভ? সকাল সাতটায় উঠতে হবে বলে মোবাইলে বা ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে লাভ কী যদি সেটা অফ করে বা ‘স্নুজ’ এ দিয়ে শুয়েই থাকেন!
সময় নিয়ে কত বড়বড় কথা আছে, ‘টাইম ইজ দ্য গ্রেটেস্ট হিলার’, ‘টাইম ইজ মানি’, টাইম অ্যান্ড টাইড ওয়েটস ফর নান’…, আমরা সবই জানি। এখন সময় হয়েছে এসব কিছুর বাস্তবায়ন করার…
“টাইম নাই” কে “গুডবাই” বলার!